অস্ট্রেলিয়ার কিছু জলাভূমি গোলাপি হওয়ার কারন কি?

পৃথিবীতে বহু আশ্চর্য্যের সন্ধান মিলেছে যুগে যুগে। বর্তমান যুগে এমনই একটি আশ্চর্যকর বিষয়বস্তু হলো অস্ট্রেলিয়ার জলাভূমি গোলাপি। নীল পানির মযনমাতানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে সমুদ্র পারে যায় অনেকেই। কিন্তু গোলাপি রঙের জলাভূমি পৃথিবীতে বিরল এবং আরো বেশি আকর্ষণীয়। অস্ট্রেলিয়াতে এমন বহু গোলাপের জলাভূমি রয়েছে যার প্রত্যেকটিই অপার বিস্ময়ে পরিপূর্ণ।

বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার একটি গোলাপি রঙের জলাভূমি সন্ধান পাওয়া গেছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের মনে নানান কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। এই জলাভূমিটি গোলাপি রঙের কেন হলো তা নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার পর অবশেষে এর রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। অনেকেই চায় সেই জলাভূমিতে গা ভাসিয়ে সাঁতার কাটতে। তাই অপার কৌতূহলের পূর্বে জেনে নিন, সেই জলাভূমি গোলাপি হওয়ার কারণ এর অবস্থান, ইতিহাস, গবেষণা, জীববৈচিত্র্য এবং নিরাপত্তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে।

অস্ট্রেলিয়ার গোলাপি রঙের জলাভূমি

অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকটি গোলাপি রঙের জলাভূমি রয়েছে। তন্মধ্যে, সবচেয়ে পরিচিত হলো হিলিয়ার লেক। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যেসকল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলো রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো অস্ট্রেলিয়ার হিলিয়ার লেক। 

এই লেকটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬০০ মিটার (২,০০০ ফুট) এবং প্রস্থে প্রায় ২৫০ মিটার (৮২০ ফুট)। ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে হ্রদটি বালির একটি পাড়, পেপারবার্ক এবং ইউক্যালিপটাস গাছের ঘন বনভূমি দ্বারা বেষ্টিত রয়েছে। এই হ্রদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর প্রাণবন্ত গোলাপী রঙ। এই জলাভূমির পানির রং স্থায়ী এবং কোন একটি পাত্রে নিলেও এই পানির রং পরিবর্তিত হয় না। 

Association of Biomolecular Resource Facilities (ABRF) এবং Metagenomics Research Group (MGRG) -এর অংশ এক্সট্রিম মাইক্রোবায়োম প্রজেক্টে এই হ্রদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিশ্লেষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন।

আরও পড়তে পারেনঃ কীভাবে সীসা বিষক্রিয়া একটি প্রজন্মের ক্ষতি করছে?

গোলাপি রঙের জলাভূমির অবস্থান

হিলিয়ার লেক অস্ট্রেলিয়ার মিডল আইল্যান্ডে বা রেচের্চে দ্বীপপুঞ্জের মধ্য দ্বীপে হিলিয়ার লেক অবস্থিত। এটি এস্পেরেন্স থেকে প্রায় ১৩০ কিমি (৭০ মাইল) দূরে অবস্থিত, তা পার্থ থেকে আট ঘন্টার পথ।

গোলাপী হ্রদটি ভারত মহাসাগরের গাঢ় নীল পানির পাশাপাশি অবস্থিত। ভারত মহাসাগরের গাঢ় নীল পানি ও গোলাপী হ্রদটির মধ্যে একটিমাত্র বাধা হিসাবে রয়েছে মায়াবী সবুজ বন। সামগ্রিক অবস্থা মিলিয়ে এটি একটি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান। এটি বিশ্বের আশ্চর্যকর ৫ লেকের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

গোলাপি রঙের জলাভূমির ইতিহাস

হিলিয়ার লেকের পানি গোলাপী রঙের হওয়ায় পৃথিবীব্যাপী মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এই জলাভূমিটিকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। অনেকেই ভাবতেন, হিলিয়ারে লবণের পরিমাণ বেশি হওয়াতেই তার পানির রং নীল না হয়ে গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। আবার অনেকের মত ছিল, ওই লেকে মাইক্রোঅ্যালগি বেশি থাকাতেই তার রং গোলাপি। তবে সম্প্রতি সে রহস্য ভেদ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

১৮০২ সালে, ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স প্রথম বলেছিলেন যে লেক হিলিয়ারের গোলাপী রঙ লবণাক্ততা থেকে এসেছে। কিন্তু পরবর্তী কয়েকশো বছরে, বিজ্ঞান প্রকাশ করেছে যে এটি একটি গল্পের অংশ মাত্র। ২০১৫-তে মিডল আইল্যান্ডের লেক হিলিয়ারের পানির রং নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এক্সট্রিম মাইক্রোবায়োমি প্রজেক্ট (Extreme Microbiome Project)-এর এক দল বিজ্ঞানী। 

এক্সএমপি-র বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন, লেক হিলিয়ারের আশপাশের লবণাক্ত পরিবেশে বেশ কিছু এক্সট্রিমোফিল থাকার জন্যে হ্রদের পানির রং এই বর্নের। (এক্সট্রিমোফিল হল তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারা কিছু আণুবিক্ষনিক জীব)।

এছাড়াও ২০১৫ সালে আণবিক জীববিজ্ঞানী কেন ম্যাকগ্রার নেতৃত্বে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মিডল আইল্যান্ডের লেক হিলিয়ারে আণবিক জীববিজ্ঞানী কেন ম্যাকগ্রার পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, হ্রদ থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ-র ২০% থেকে ৩৩% স্যালিনিব্যাকটের রাবার দ্বারা তৈরি। বিজ্ঞানীরা সেখানে ১০ প্রজাতির হ্যালোফিলিক ব্যাকটেরিয়া, আর্কিয়া এবং সেইসাথে বেশ কয়েক প্রজাতির শৈবাল খুঁজে পেয়েছিল। 

এই অনুজীবগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোরই কিছু গোলাপী, লাল বা স্যামন রঙের রঙ্গক ছিল। এগুলো লবণাক্ত পরিবেশে থাকতে ভালবাসে। তাছাড়া এখানে রয়েছে, বিভিন্ন প্রজাতির ডানালিয়েলা অ্যালগি বা শ্যাওলা। যার বেশির ভাগের রং সবুজের পরিবর্তে গোলাপী বা লাল রঙের। মূলত এর প্রভাবেই লেক হিলিয়ার পানি গোলাপি রঙের হয়।

হিলিয়ার পানি গোলাপি রঙের কেন?

উপরোক্তভাবে গবেষণার পর, ২০২২ সালের এক গবেষণায় লেক হিলিয়ারের গোলাপী পানিকে সুক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। গবেষণা অনুযায়ী এই হ্রদের পানি সমুদ্রের পানির চেয়ে আট গুণ বেশি লবনাক্ত। এক্সট্রিম মাইক্রোবায়োম প্রজেক্টের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ‘স্কট টাইগে’ জলাভূমি হিলিয়ার সম্পর্কে জানার পর এর প্রাণবন্ততার পিছনের রহস্যটি উন্মোচনের জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

অণুজীব প্রজাতির রং নীল থেকে কমলা রঙের। আর তাদের মধ্যে থাকা ক্যারোটিনয়েডের ফলে লাল হতে পারে। ধারণা করা হয় যে, ক্যারোটিনয়েড গুলো উচ্চ লবণাক্ত পরিবেশের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ১৮০২ সালে ফ্লিন্ডার্সের দেওয়া ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল ছিল না। কারণ তিনি বলেছিলেন লেকের পানির গোলাপী রং ধারণ করার অন্যতম কারণ লবণাক্ততা।

এ বিষয়ে গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মিশেল বারফোর্ড বলেন “আমি মনে করি যে আমরা এখানে গোলাপী শৈবালের ঘনত্ব দেখতে পাচ্ছি৷ এগুলো সম্ভবত কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে বেড়াবে এবং তারপরে বাতাস বা পানির জোয়ার তাদের আবার ছড়িয়ে দেবে এবং তাদের আর দেখতে পাওয়া যাবে না।

গোলাপি জলাভূমির জীববৈচিত্র্য

হিলিয়ার হ্রদের জীববৈচিত্র তেমন সমৃদ্ধ নয়। এখানে একমাত্র জীবন্ত প্রাণী হিসেবে অণুজীবদেরই চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডুনালিয়েলা স্যালিনা, লাল শৈবাল যা জলাভূমির পানিতে থাকা লবণের সংমিশ্রনে গোলাপি আভা তৈরি করে। এছাড়াও রয়েছে লাল হ্যালোফিলিক ব্যাকটেরিয়া, ব্যাকটিরিওবারিন ইত্যাদি অনুজীব, যা লবণের ভূত্বকে উপস্থিত থাকে।

২০১৬ সালে এক্সট্রিম মাইক্রোবায়োম প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা বিস্তৃত মাইক্রোবায়োম এবং মেটাজেনমিক ডিএনএ সিকোয়েন্সিং পরিচালনা করেন। তখন তাদের গবেষণায়, হ্যালোকোয়াড্রাটাম, হ্যালোফের্যাক্স, স্যালিনিব্যাক্টর, হ্যালোব্যাকটেরিয়াম, হ্যালোজিওমেট্রিকাম এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি হ্যালোফিলিক জীব সনাক্ত করা হয়েছিল।

আপনি কি অস্ট্রেলিয়ার গোলাপী পানিতে সাঁতার কাটতে পারবেন?

অস্ট্রেলিয়ার হিলিয়া লেকটির স্ট্রবেরি দুধের রঙের বা গোলাপি রং হওয়ার কারণ ব্যাকটেরিয়া হওয়া সত্ত্বেও, হিলিয়া লেক সাঁতারের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ। সমুদ্রের পানি থেকে সেই প্রাণীর লবণাক্ততা প্রায় ৮ গুণ বেশি হওয়ায় লেকের উচ্চ লবনাক্ত পানির গঠন অনেক বেশি ঘন। পানির ঘনত্ব বেশি হওয়ায় সহজেই সেখানে ভেসে থাকা যায় এবং নিশ্চিন্তভাবে সাঁতার কাটা যায়। দর্শনার্থীদের মতে, মৃত সাগরের মতো হিলিয়ার লেকে মানুষ ভেসে থাকে।

অস্ট্রেলিয়ার গোলাপী জলাভূমিতে যাতায়াত ব্যবস্থা 

অস্ট্রেলিয়ার গোলাপী জলাভূমিটি একটি ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত এবং সেখানে যাবার যাতায়াত ব্যবস্থা খুব একটা উন্নত নয়। হেলিকপ্টার বা নৌপথে বোট এর মাধ্যমে সেই জলাভূমির অঞ্চলে পৌছাতে পারলেও তা অনেক বেশি দুর্গম ও দূরহ। 

গোলাপি জলাভূমিতে যেতে অতি উৎসাহীদের জন্য এয়ারপ্লেন সিনিক ফ্লাইট গুলোই সবচেয়ে সাধারণ এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। প্রতিদিন এস্পেরেন্স বিমানবন্দর থেকে গোলাপি জলাভূমির দিকে ছয়টি ফ্লাইট ছেড়ে যায়। নিকটস্থ কেপ লে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক হয়ে লেক হিলিয়ারের উপর দিয়ে এই ফ্লাইটগুলোর চলাচল। বিচ্ছিন্ন হ্রদ এবং আশেপাশের বনাঞ্চল পরিদর্শন করতে ইচ্ছুক যাত্রীদের জন্য ক্রুজগুলোও বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ার গোলাপি জলাভূমি থেকে দূরে থাকতে বলেছে কেন?

অস্ট্রেলিয়ার গোলাপী জলাভূমিটি বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু গবেষকরা এই ধরনের জলাভূমি থেকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এর প্রধান কারণগুলো হলো:

সম্ভাব্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া: গোলাপি জলাভূমির পানি গোলাপি হওয়ার প্রধান কারণ ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল সহ বিভিন্ন অনুযায়ী। এ সকল প্রাণী খাওয়া হলে, শরীরের ভেতরে চলে গেলে কিংবা শরীরের ক্ষতস্থানে লাগলে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।

পানির অনিশ্চিত গুণমান: হিলিয়ার লেকে থাকা লবণাক্ততা ও দূষণকারী পদার্থগুলো কিংবা নানা রকম অপরিচিত অনুজীব এই পানির গুণমানকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। তাই এর গুনমান না জেনে পানিতে নামা উচিত নয়।

পরিবেশগত সংবেদনশীলতা: গবেষকদের মতে, পর্যটকরা এই স্থানে খুব বেশি পরিদর্শন করতে গেলে সেখানের বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব পড়বে। জলাভূমিতে হাঁটা বা সাতারকাটা অণুজীব গুলোর জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।

নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ: রঙিন এই জলাভূমির আশেপাশের ভূখণ্ড কুইকস্যান্ড বা অ-স্থীর মাটির মত অনিশ্চিত বিপদের কারণ হতে পারে। তাই এটি দর্শণার্থীদের জন্য ও নিরাপদ স্থান বলে মনে করা হয়।

এ সকল বিষয়গুলো বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়ার গোলাপি জলাভূমি থেকে সকলকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করেছেন।

শেষকথা

অস্বাভাবিক বর্ণের জলাভূমি হওয়া সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত মানুষের উপর এর কোন বিরূপ প্রভাব দেখা যায়নি। হেলিকপ্টার থেকে পরিদর্শন করার সময় হ্রদটি একটি কঠিন বুদ্বুদ গামের মতো গোলাপী দেখায়, কিন্তু উপকূল থেকে এটি একটি পরিষ্কার গোলাপী আভা। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান। তাই এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার ছলে এই প্রাকৃতিক সম্পদটির জীববৈচিত্র ধ্বংস করা থেকে সকলের বিরুদ্ধে থাকা উচিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *