ভূমিকম্প কেন হয়? ভূমিকম্পে কী করণীয়

ভূমিকম্প কেন হয়? ভূমিকম্পে কী করণীয়ঃ ‘অমুক জায়গায় এত মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে’ এটি আমাদের প্রায় সবারই একটি চেনা হেডলাইন। পাশের বন্ধু মজা করেও যদি বলে ভূমিকম্প হচ্ছে, তাহলেও আপনাকে হয়তো টেবিলের নিচে খুঁজে পাওয়া যাবে।

ভূমিকম্পের নাম শুনলেই আমরা যেন ভয়ে কেঁপে উঠি। অন্য কোন  প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পর কোন পূর্বাভাস দিয়ে আশে না, তাই ভূমিকম্পে হতাহত কিংবা ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও বেশি হয়ে থাকে।

ভূমিকম্প কেন হয়? ভূমিকম্পে কী করণীয়

ভূমিকম্প কেন হয়, ভূমিকম্প হলে করনীয়
কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন ভূমিকম্প কেন হয়? আজ আমরা ভূমিকম্প নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, সেইসাথে জানবো ভূমিকম্প হলে করণীয় কি? এবং কিছু ভূমিকম্প নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা।

ভূমিকম্প হওয়ার কারণ

ভূমিকম্প কি? 
ভূমিকম্প কেন হয়? ভূকম্পন অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠ যখন অল্প সময়ের জন্য কেঁপে ওঠে তাকে আমরা ভূমিকম্প বলি।ভূমিকম্প পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে জায়গায় সৃষ্টি হয় তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলা হয়। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিলোমিটার হতে ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
** ভূমিকম্পন হওয়ার ভূমিকম্প হওয়ার জন্য অনেক কারণ আছে।আমাদের ভূপৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেট এর সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো একটি আরেকটি থেকে পৃথক। এগুলোকে টেকটনিক প্লেট বলা হয়। আমাদের পৃথিবীকে ১৫ টেকটনিক প্লেট এ ভাগ করা হয়েছে। যখন একটি প্লেট আরেকটি প্লেটের এর মধ্যে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করে তখনই ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
** আবার যখন পৃথিবীর অভ্যন্তরে শিলা চ্যুতি ঘটে তখন ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
** অনেক সময় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাবে ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়।
** পাহাড় থেকে বিশাল কোন পাথর খন্ড ভূমিতে পড়ে গেলে ভূমিকম্প হতে পারে।
** ভূপৃষ্ঠ তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয়ে সংকুচিত হলে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ভূপৃষ্ঠ খানিকটা ভেতরে ঢুকে যায় এবং এতে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

** অনেক সময় মানবসৃষ্ট কারণে ও ভূমিকম্প হতে পারে। পারমানবিক বোমা পরীক্ষণের জন্য যে বিস্ফোরণ হয় তার জন্য ভূমিকম্প হতে পারে আবার পাহাড় ধ্বংস করার জন্য বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এতেও ভূমিকম্প হতে পারে। আশাকরি, ভূমিকম্প কেন হয় তা সকলেই বুঝতে পেরেছেন।

আরও পড়তে পারেনঃ জোয়ার ভাটা কেন হয়?

ভুমিকম্পের মাত্রা কিভাবে মাপা হয়?

আজ পর্যন্ত এমন কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি যার দ্বারা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। তবে ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা যায়। ভূমিকম্প পরিমাপের পদ্ধতিকে বলা হয় সিসমোগ্রাফ আর ভূমিকম্প পরিমাপের যন্ত্রকে বলা হয় রিখটার স্কেল। রিখটার স্কেলে ০ থেকে ১০ পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। রিখটার স্কেলের মান এর উপর ভিত্তি করে ভূমিকম্পকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় :
মাঝারি মাত্রা : ৫ – ৫.৯৯
তীব্র মাত্রা : ৬-৬.৯৯
ভয়াবহ মাত্রা : ৭-৭.৯৯
অত্যন্ত ভয়াবহ : ৮ এর উপরে
ভূমিকম্প হলে ৩ ধরনের ওয়েভ বা তরঙ্গ সৃষ্টি হয় 
প্রাইমারি ওয়েভ : এগুলো সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন;
সেকেন্ডারি ওয়েভ : মাঝারি গতিসম্পন্ন;

সার্ফেস ওয়েভ : সবচেয়ে কম গতিসম্পন্ন। এ ধরনের তরঙ্গ ভূপৃষ্ঠে আঘাত হানে।

 

অন্য প্রাণীরা কি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায়?

আমরা অনেকেই এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত যে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণী ভূমিকম্প ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায় কিনা? এ বিষয়টি পুরোপুরি সত্য। প্রাণীরা ভূমিকম্প কেন যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস আগে থেকেই পেয়ে যায়। বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন প্রাণীর অস্বাভাবিক কিছু আচরণ লক্ষ্য করেছেন যার পরবর্তী সময়ে ওই জায়গায় ভূমিকম্প বা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। ভূমিকম্প কেন হয়, সে তথ্য থেকে আমরা জানি যে, এটি আকস্মিক। কিন্তু প্রানীরা তা বুঝতে পারে।
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস

 

১৮৫৫ সালে টোকিও শহরের কয়েকটি জায়গায় হঠাৎ করে হাঁস-মুরগির ডিম দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তারা যেন খাঁচাতে আর ঢুকতে চাইত না। তারা এমন করতে শুরু করেছিল যেন তারা এখান থেকে পালাতে চাইছে। পরে সে জায়গাতে আঘাত হানে বড় ধরনের ভূমিকম্প।
১৮৫৭ সালে ইতালির জেনোয়া শহর পায়রা শুন্য হয়ে গেছিল অথচ যে শহরে যাঁকে যাঁকে পায়রা উড়ে বেড়ানো ছিল পরিচিত দৃশ্য। পায়রা শূন্য হওয়ার কয়েক দিন পরই ওই শহরে ভূমিকম্প আঘাত হানে।
১৮৯৬ সালে চীনের তিয়েনসিনের বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়। মাত্র ৪ দিন আগে সেখানকার চিড়িয়াখানায় থাকা প্রাণীগুলো প্রচণ্ড চিৎকার করতে থাকে। পাখিরাও অস্থির হয়ে গেছিল।
২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি ঘটার পূর্বে গভীর সমুদ্র থেকে প্রচুর মাছ উপকূলে জেলেদের জালে এসে ধরা দেয়।
এ বছরই শ্রীলঙ্কায় আঘাত হানা সুনামি এর ঠিক ৩ ঘণ্টা আগে শ্রীলংকার একটি পার্কে হাতিগুলো চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দেয়। বাঘ, হায়েনাকে খাবারের লোভ দেখিয়েও খাঁচা থেকে বের করা সম্ভব হয়নি। নব্বই এর দশকে চীনের বেইজিং এ সাপ, ইঁদুর রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল। কিছুক্ষণ পরই আঘাত হেনেছিল ভূমিকম্প। একথা শুনা যায় যে ভূমিকম্পের পূর্বে সেখানকার কুকুর গুলো চিৎকার করছিল। এ রকম আরো হাজারো উদাহরণ রয়েছে।

প্রাণীরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায় কিভাবে?

এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা চলছে। অনেকে আবার অনেক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে যে পায়রার মধ্যে কম্পন অনুভব করার অদ্ভূত এক ক্ষমতা রয়েছে। কুকুর ২০ হার্জ এর কম কম্পাঙ্কের শব্দ বুঝতে পারে।
অনেক বিজ্ঞানীরা এ কথা বলেছেন যে ভূমিকম্প হওয়ার সময় অনেক পজিটিভ আয়ন তৈরি হয়। আর পশু পাখিদের পজিটিভ আয়ন অয়ন খুব দ্রুত বুঝতে পারে। অনেক সময় আমরাও আগাম বিপদের আভাস পাই যাকে আমরা সিক্সথ সেন্স বলি।

ভূমিকম্প নিয়ে যত ভ্রান্ত ধারণা – ভূমিকম্প কেন হয়?

ভূমিকম্প নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। যেমন গ্রিক জাতির ধারণা অনুযায়ী ভূমিকম্পের দেবতা পোসাডাইন। তিনি যখন খারাপ মেজাজে থাকেন তখন ত্রিশূল দিয়ে ভূপৃষ্ঠে আঘাত করেন। এতে ভূমিকম্প হয়। আবার মানুষ যখন খারাপ কাজ করে তখন দেবতা রুষ্ঠ হয়ে এরকম আচরণ করেন বলেও মানুষের মাঝে ধারণা প্রচলিত আছে।
পশ্চিম আফ্রিকানদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে আমরা একটি দৈত্যের মাথায় বাস করি। গাছপালা হলো ওই দৈত্যের চুল ও মানুষ ও পশুপাখিরা হচ্ছে পরজীবীর মত। মাঝেমধ্যে দৈত্য মাথা ঘুরালে ভূমিকম্প হয়।

হিন্দু পুরাণ মতে পৃথিবী কে ৮ টি হাতি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর হাতি দাঁড়িয়ে আছে একটি সাপের মাথায়। যখন এদের কেউ নড়াচড়া করে তখন ভূমিকম্প হয়। এরকম আরো হাজারো ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে ভূমিকম্প কেন হয়, তা নিয়ে।

ভূমিকম্প হলে কি করনীয় :

ভূমিকম্প কেন হয়, সে সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু একবার ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেলে আমাদের কি করা উচিত, সে সম্পর্কে বিস্তারিত প্রস্তুতি থাকা উচিত। চলুন সে সময়ে আমাদের করনীয় গুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাকঃ

ভূমিকম্পে করণীয়
** ভূমিকম্প হচ্ছে টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা জায়গায় অবস্থান নেন।
** আপনি যদি উঁচু ভবনে থাকেন আর ভবন থেকে বের হতে না পারেন তাহলে শক্ত কোন বীম, টেবিল বা সোফার নিচে অবস্থান নিন।
** বহুতল ভবনে অবস্থান করলে একসাথে সবাই না থেকে ভাগ ভাগ হয়ে আশ্রয় নিন।
** আপনি আপনার নিজ ঘরের গ্যাস এবং বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে দূরে অবস্থান করুন।
** উঁচু ভবন থেকে নামার জন্য লিফট ব্যবহার করবেন না কিংবা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়বেন না।
** গাড়িতে থাকলে গাড়ি খোলা জায়গায় থামিয়ে দিন এবং গাড়িতে অবস্থান করুন।
** হতবিহ্বল না হয় ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করুন।
ভূমিকম্প কেন হয় এবং ভূমিকম্প নিয়ে আশা করি আপনি এখন অনেক কিছুই জানেন। আমাদের অসাবধানতা এবং অসচেতনতার কারণে ভূমিকম্পে হতাহতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাই নিজে সঠিক তথ্য জানুন এবং অপরকেও সাবধান করুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *