কেন আমাদের সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার?

বর্তমানে পৃথিবীবাসীর মাঝে অন্যতম বিশেষ কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠেছে সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট। বিজ্ঞানী এবং গবেষকরাও এর সম্পর্কে সতর্ক এবং মনোযোগী হতে আহ্বান করেছেন। কিন্তু এই সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট কী, এর পরিচিতি, অবস্থান এবং কেন আমাদের সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার, সে সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনেই। তাই বিশ্বস্ত মাধ্যম থেকে সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো এই লেখাতে।

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট কী?

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সুপরিচিত একটি ফল্টলাইন। এটি মুহূর্তের মধ্যেই পৃথিবীর বৃহত্তম অঞ্চলজুড়ে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।

সাধারণত, যে সকল স্থানে একটি টেকটোনিক প্লেটের সাথে অন্য একটি টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ হয়/ একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে/ দুইটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝে ফাটলের তৈরি হয়, সেই স্থানগুলোকে ফল্টলাইন বলা হয়। 

একটি ফল্টলাইন কে পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্যে একটি ফ্র্যাকচারও বলা হয়। যখন এই ফ্রাকচারের আশেপাশে থাকা পাথর ও মাটি টেকটোনিক শক্তির প্রভাবে পৃথিবীর ভূত্বকের উপর আন্দোলিত হয় তখন ছোট ছোট ফল্ট লাইনগুলো বড় আকার ধারণ করে এবং ভূত্বক ফেটে তা পৃথিবীর মানচিত্রে প্রকাশিত হয়। সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট এমনি একটি বড় আকারের ফল্ট হিসেবে গড়ে উঠেছে। যেকোনো সময় এর প্রভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল এলাকাতে অবস্থিত হওয়ায় সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের প্রভাবে বিপদের আশঙ্কা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

আরও পড়তে পারেনঃ কীভাবে সীসা বিষক্রিয়া একটি প্রজন্মের ক্ষতি করছে?

কেন সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট গুরুত্বপূর্ণ?

বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি হলো সান আন্দ্রেয়াস ফল্টলাইনের নিকটবর্তী এলাকাগুলো। কারন বহু দেশে প্রায় ৪০০ বছর ধরে বিভিন্ন টেকটোনিক প্লেটগুলো ধীরগতিতে অল্প অল্প করে নিজেদের স্থান পরিবর্তন করছে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ভূমিকম্প সংগঠিত হচ্ছে এবং অন্যান্য স্থানগুলোও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সান আন্দ্রেয়াস পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফল্টলাইন এবং গবেষকরা এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করেছেন। এটি প্রায় ৮.৬ মাত্রায় ভূ-কম্পন সৃষ্টি করতে সক্ষম। এতে সান আন্দ্রেয়াস ফল্টলাইনের সংশ্লিষ্ট শহর গুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এ নিয়ে সকলের মনেই বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সর্তকতা অবলম্বনের জন্য সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট গুরুত্বপূর্ণ।

সান আন্দ্রেয়াসের ইতিহাস

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত ভূতাত্ত্বিক এবং বিজ্ঞানীদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ম্যাপের উপর ভিত্তি করে ১৯ শতকের শেষের দিকে এই বিশাল ফল্টটি চিহ্নিত করে এর নামকরণ করা হয়েছিল। 

তৎকালীন আমেরিকান জিওফিজিসিস্ট হ্যারি ফিল্ডিং রিড, ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে সংগঠিত হওয়া বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর রুটি সনাক্তকরণ এবং ভূমিকম্পের ক্রিয়া-কলাপের উপর টেকটোনিক প্লেটের ভূমিকা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছিলেন। তখন তিনি সেই অঞ্চলের প্রধান টেকটোনিক সীমানা আবিষ্কার করেন এবং এটি একক ব্যক্তির দ্বারা উদ্ভাবিত না হয়ে সম্মিলিতভাবে বহু বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আরও পড়তে পারেনঃ উইকিপিডিয়া থেকে।

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট এর অবস্থান 

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের প্রায় ৮০০ মাইল (১,৩০০ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে প্রসারিত। পৃথিবীর বিশাল ২টি ভূ-ত্বকীয় টেকটোনিক প্লেট, প্যাসিফিক প্লেট এবং উত্তর আমেরিকান প্লেটের মধ্যবর্তী সীমানা প্রকাশ পায় এই ফল্ট লাইনের মাধ্যমে। এই ফল্ট নেটওয়ার্কটি ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের শিলা ভেদ করে পৃথিবীর মধ্যে অন্তত ১০ মাইল গভীরতা পর্যন্ত প্রসারিত।

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট লাইনের প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট উত্তর-পশ্চিমে সরে যাচ্ছে এবং উত্তর আমেরিকান প্লেট দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাচ্ছে। এটি উত্তর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে শুরু হয়ে কেপ মেন্ডোসিনোর দক্ষিণ পর্যন্ত প্রসারিত। এটি সান্তা রোসা, সান ফ্রান্সিসকো, ডেজার্ট হট স্প্রিংস, সান জোসের মতো বড় শহরগুলোর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলে গেছে এবং লস অ্যাঞ্জেলেস ও সালটন সাগরের বাইরে সান বার্নার্ডিনোতে পৌঁছেছে। পাশাপাশি এই বিশাল ফল্ট লাইনের মধ্য থেকে বিভিন্ন ছোট ছোট শাখা ফল্ট লাইন প্রসারিত হয়েছে। তন্মধ্যে, একটি গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালার উত্তর প্রান্তের মতো কম জনবসতিপূর্ণ এলাকাতেও প্রসারিত হয়েছে।

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট বিপদজনক কেন?

নিকটবর্তী অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকার কারণে সান আন্দ্রেয়াস ফল্টটিকে বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়। ফল্ট লাইনের কাছাকাছি থাকা ২টি প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ হলে পৃথিবীর ভূত্বকে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। 

ফল্ট লাইনের সংযোগস্থলে ফল্টটি চলমান চাপ এবং চাপ তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করে। যখন এই চাপ মুক্তি পায়, তখন এটি শক্তিশালী ভূ-কম্পণের ঘটনা ঘটাতে পারে।সৃষ্টি করে। এই বৃহদাকার টেকটোনিক প্লেটগুলোর মধ্যে থাকা ফল্টটির বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বিবেচনা করলে, এটি যথেষ্ট বঢড় মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।  

সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের বিভিন্ন অংশ এবং ভূমিকম্পের মাত্রা 

মূলত সান আন্দ্রেয়াস হলো এমন একটি ফল্ট, যেখানে পৃথিবীর ভূত্বকের একটি ফাটলের দুটি পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে চলে। পৃথিবীতে ডাইভারজেন্ট ফল্ট, কনভারজেন্ট ফল্ট এবং ডিপ-স্লিপ ফল্ট সহ বিভিন্ন ধরনের ফল্ট রয়েছে। সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট মূলত স্ট্রাইক-স্লিপ বা রূপান্তর ফল্ট। 

স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট তূলনামূলকভাবে বেশি বিপজ্জনক। কারন এর থেকে সৃষ্ট ফ্র্যাকচারের দুই দিক ফল্টের অনুভূমিক এবং সমান্তরালে সরে যায়।  দুই পক্ষ একে অপরকে অতিক্রম করে অনুভূমিকভাবে চলে যায়।  

সান আন্দ্রেয়াস ফল্টটি প্রধানত ৩ টি অংশে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগেরই আলাদা আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকি সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিটি ভাগের ভিন্ন মাত্রা রয়েছে। এই ফল্টের ভাগগুলো হলো:

(১) উত্তর অংশ: এই অংশটি মেন্ডোকিনো কাউন্টির পয়েন্ট ডেলগাদা থেকে মন্টেরি কাউন্টির পার্কফিল্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। সান আন্দ্রেয়াসের ডান-দিকের ছোট আকারের স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্টগুলোর ধারাবাহিকতা দেখে উত্তর অংশের ফল্টটি চিহ্নিত করা যায়।

(২) কেন্দ্রীয় অংশ: এই অংশটি সান বেনিটো কাউন্টির পার্কফিল্ড থেকে হলিস্টার পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি অ্যাসিসমিক ক্রীপ নামক একটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য/ অবস্থা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এই স্থানে খুব বেশি ভূমিকম্প দেখা যায় না, ক্রমাগত ফল্ট স্লিপ হয়।

(৩) দক্ষিণ অংশ: এই অংশটি হলিস্টার থেকে সালটন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি বেশ কয়েকটি ডান-দিকের ছোট আকারের স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত এই অংশটি তুলনামূলকভাবে বড় ভূমিকম্প তৈরি করতে সক্ষম।

সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের কারণে কি কি বিপর্যয় ঘটেছে?

পৃথিবীর ইতিহাসের বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ ছিল সান আন্দ্রেয়াস। এ সকল ভূমিকম্পের জন্য বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই ফল্টলাইন দ্বারা সৃষ্ট সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিপর্যয় গুলো হলো:

ফোর্ট তেজোন ভূমিকম্প (১৮৫৭) 

১৮৫৭ সালে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ফোর্ট তেজনের কাছে সান আন্দ্রেয়াসের প্রভাবে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৯। যদিও সেই সময়ে জনসংখ্যা খুব কম ছিল, তাই মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কম। তবে এটি ফল্ট বরাবর ভূপৃষ্ঠে উল্লেখযোগ্য ফাটল সৃষ্টি করেছিল এবং এটি ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে রেকর্ড করা বৃহত্তম ভূমিকম্প গুলোর মধ্যে এটি স্থান করে নিয়েছিল।

গ্রেট সান ফ্রান্সিসকো ভূমিকম্প (১৯০৬)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্প গুলোর মধ্যে ১৯০৬ সালের ১৮ই এপ্রিল গ্রেট সান ফ্রান্সিসকো ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল আনুমানিক ৭.৮। বড় মাত্রার এই ভূমিকম্পের পর এই সান ফ্রান্সিসকোতে সংগঠিত হয়েছিল বিধ্বস্তকারী অগ্নিকাণ্ড। এরপরে ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও প্রাণহানি হয় এবং অসংখ্য মানুষ বাসস্থানহীন হয়ে পড়েছিল।

পয়েন্ট রেয়েস ভূমিকম্প (১৯০৬)

গ্রেট সান ফ্রান্সিসকো ভূমিকম্পের সাথে একযোগে আরেকটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল, যা পয়েন্ট রেয়েস ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এটিও সান আন্দ্রেয়াসের ফল্ট লাইনের প্রভাবে হয়েছিল। এই ভূমিকম্পের ফলে পয়েন্ট রেয়েসের নিকটবর্তী অঞ্চলে গভীর কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল, যা অতিরিক্ত ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করেছিল।

আরো পড়ুন: পচা ডিম পানিতে ভাসে কেন?

যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে আরো বহুবার সান আন্দ্রেয়াসের ফল্ট লাইনের প্রভাবে নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছিল এই ফল্টের নিকটে বসবাসকারীরা। নিয়মিত নড়াচড়া করতে থাকায় ভূমিকম্পের জন্য চলমান ঝুঁকি তৈরি এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের জন্য এটি মারাত্মক ভূমিকা রাখতে পারে।

সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট সম্পর্কে ৫টি আকর্ষণীয় তথ্য

  • সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট বিশ্বের দীর্ঘতম ফল্টগুলির মধ্যে একটি। এর দৈর্ঘ্য প্রিয় ৮০০ মাইল প্রসারিত।
  • ভূমিকম্পের জন্য এর খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও, এটি ধীরে ধীরে প্রতি বছর প্রায় ২ ইঞ্চিসরে যায়।
  • বহুদিন যাবত এটি ক্যালিফোর্নিয়ার ল্যান্ডস্কেপকে নতুন আকার দিয়েছে, পাহাড় এবং উপত্যকা তৈরি করেছে।
  • সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের বিভিন্ন শাখা রয়েছে। ফলে এটি একাধিক ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
  • বর্তমানে বিজ্ঞানীরা একটি বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিয়েছেন, কারন সান আন্দ্রেয়াসের অংশগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য চাপ তৈরি হয়েছে৷

শেষকথা

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বিস্তারিত তথ্যগুলো জানা যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী ভূমিকম্পের সম্ভাবনাটি সত্যি হলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যেকোনো সময় পৃথিবীর বুকে আঘাত হানতে পারে এই মারাত্মক বিপর্যয়টি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *