রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি কি?

মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রক্ষায় যে জিনিসটির গুরুত্ব অত্যাধিক তা হলো ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ এই ডার্ক ম্যাটারের নাম হয়তো শুনেছি। কিন্তু কি এই ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণা নেই।

ধরুন একদিন আপনি বাইরে থেকে বাসায় এসে হাত ধুতে গেলেন। ধোয়া শেষে হাতের অতিরিক্ত পানিকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছেন। কিন্তু একি! আপনার হাত থেকে এক ফোঁটা পানিও বাইরে আসছে না। এমন যদি কখনো ঘটে, ধরে নিবেন আপনার হাতে ডার্ক ম্যাটার বাসা বেঁধেছে।

এমনটা আসলে কখনো হয় না। হওয়া সম্ভবও না। কিন্তু চিন্তা করুন তো, যদি সত্যি সত্যি এমনটা হতো, বিষয়টা কেমন হতো? অবশ্যই খুব আশ্চর্যজনক। কিন্তু এই আশ্চর্য জিনিসটির জন্যই আমাদের সমগ্র মহাবিশ্বের অস্তিত্ব টিকে আছে।

ডার্ক ম্যাটার আসলে কি?

ডার্ক ম্যাটার
সত্যি বলতে এটি সম্পর্কে প্রায় কিছুই আমরা জানি না। শুধু যে জিনিসটি জানি তা হলো, এটি এমন একটি বস্তু যা মহাবিশ্বে প্রচুর পরিমানে রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত মহাকর্ষ বলের যোগান দিয়ে আসছে।
 

গুপ্ত বস্তু ডার্ক ম্যাটার ( Dark Matter ) আবিষ্কারের ঘটনা

সুইডিশ বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জুইকি প্রথম এই ম্যাটার আবিষ্কার করেন। তিনি কোমা ক্লাস্টারের মধ্যকার ছায়াপথ গুলোর গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি দেখলেন, হাজার হাজার ছায়াপথ এই ক্লাস্টারের কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল এক জায়গায়।

তিনি দেখলেন, যেই পরিমাণ ভর এই ক্লাস্টারে রয়েছে, সেই পরিমাণ ভর কোনমতেই এত সুন্দর ভারসাম্য বজায় রাখতে যথেষ্ট না।কারণ, ক্লাস্টারে বিদ্যমান ভরগুলোর যোগদানকৃত মহাকর্ষ বলের পরিমাণ, আর ক্লাস্টারটিকে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মহাকর্ষ বলের পরিমাণের মধ্যে ছিল বিস্তর তফাৎ।

যদি শুধু দৃশ্যমান বস্তুগুলোর যোগান দেয়া বল ই থাকতো, তাহলে কবেই ক্লাস্টারের বস্তুগুলো ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। কিন্তু না, হাজার হাজার বছর ধরে এরা খুব সুন্দর ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে। মোদ্দা কথা, প্রয়োজনীয় ভরের তুলনায় কোমা ক্লাস্টারের ভর ছিল খুবই কম।

যদি শুধু কোমা ক্লাস্টারের বেলায় এমনটি হতো, তাহলে একে ব্যতিক্রম কিছু বলে মেনা নেয়া যেত। কিন্তু না! ফ্রিটজ জুইকি পরে আরো অনেক ক্লাস্টারের বেলায়ও এমন ঘটনা ঘটে। সমস্যাটা আসলে এখানেই।

এরপর বিজ্ঞানীরা একটি সম্ভাবনার কথা জানালেন। এমন কোনো বস্তু রয়েছে যা আমরা এখনো আবিষ্কার করতে পারি নি। এই রহস্যময় জিনিসটাই সব কিছুর মূল।

তাহলে এই অতিরিক্ত বলের জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত ভর, অতিরিক্ত বস্তু। কারণ বস্তু ব্যতীত বলের যোগান সম্ভব না। আবার কোনো এক উৎস থেকে ঠিকই বলের যোগান আসছে। তার মানে অবশ্যই এই অতিরিক্ত বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে।

এর মানে একটি জিনিসই দাঁড়ায়। তা হলো যে পরিমাণ বস্তু আমরা মহাবিশ্বে দেখতে পাই, সেই পরিমাণ বস্তুই আসলে সম্পূর্ণ জিনিস না। এর বাইরেও অতিরিক্ত জিনিস আছে, যা এই বলের যোগানদাতা। আর এরা সম্পূর্ণভাবে আমাদের কাছে অদৃশ্য। ফ্রিটজ জুইকি এর নামকরণ করেন “ডার্ক ম্যাটার”।

১৯৭৬ সালে বিজ্ঞানী ভেরা রুবিনও একই জিনিস লক্ষ্য করেন। তিনি ছায়াপথ গুলোর মধ্যেও একইরকম ভরের গড়মিল আবিষ্কার করলেন।

ছায়াপথের মধ্যকার নক্ষত্ররা ছায়াপথের কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে। যেমনটা আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। একইসাথে নক্ষত্রগুলো নিজের কক্ষপথ ধরে ঘুরে চলে।

সেই বিবেচনায়, যেই নক্ষত্র কেন্দ্র থেকে যতদূরে, তার বেগও তত বেশি হওয়ার কথা। যেহেতু এই দূরের নক্ষত্ররা তাদের গতিশক্তি ব্যবহার করে দিন দিন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। এতদিনে তাদের কেন্দ্রমুখী বেগ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভেরা রুবিন দেখলেন, তাদের কেন্দ্রমুখী বেগ এখনও আগের মতই প্রবল।

কিন্তু ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে নক্ষত্র অবধি খালি অঞ্চলে তেমন কোনো বস্তুই নেই। যার জন্য নক্ষত্রগুলোর বেগ এত বেশি হচ্ছে। এর থেকে রুবিন সিদ্ধান্ত নিলেন, এই খালি অঞ্চলে নিশ্চয়ই রয়েছে ডার্ক ম্যাটার। উল্লেখ্য, এই অঞ্চলগুলোকে বলা হয় “ডার্ক ম্যাটার হ্যালোস”।

ডার্ক ম্যাটার এর প্রকৃত পরিমাণ কত?

ফ্রিটজ জুইকি সর্বপ্রথম এর পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি যে পরিমাণের কথা বলেন, তা ছিল প্রকৃত পরিমাণ অপেক্ষা অনেক বেশি। অবশেষে ভেরা রুবিন এর মোটামুটি প্রকৃত একটা পরিমাণ নির্ণয় করতে সক্ষম হন।

ডার্ক এনার্জি

আসলে স্থান কাল ভেদে এই পরিমাণ একেক ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে। তবে পুরো মহাবিশ্বকে ধরে হিসাব করলে এর গড় পরিমাণ হয় দৃশ্যমান বস্তুর তুলনায় ৫-৬ গুণ!

অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্বে যে পরিমাণ দৃশ্যমান বস্তু রয়েছে, তার তুলনায় ডার্ক ম্যাটার রয়েছে ৫-৬ গুণ বেশি! কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই ডার্ক ম্যাটার চোখে দেখা দূরে থাক, শনাক্ত করাও সম্ভব হয় না।

ডার্ক ম্যাটার খুঁজে পাওয়া যায় না কেন?

প্রথমত, এটি দেখা বা শনাক্ত করার মত যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।

দ্বিতীয়ত, এর ধর্মের জন্য। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই কমবেশি আলো নির্গত করে, আলো বিকিরণ করে। এমনকি ব্ল্যাক হোল নিজেও আলো বিকিরণ করে। যাকে বলা হয় হকিং রেডিয়েশন।

কিন্তু ডার্ক ম্যাটার এমন এক জিনিস, যা না করে কোনো রেডিয়েশন, না কোনো আলো আমাদের দেয়। ফলে একে শনাক্ত করা বর্তমান প্রযুক্তি অনুযায়ী অসম্ভব।

এমনকি, এটি সাধারণ কোনো বস্তু যা কিনা দেখা যায় বা শনাক্ত করার মত এমন কোনো জিনিসের সাথেও মিথস্ক্রিয়া করে না। তার মানে এখন যদি কিছু পরিমাণ ডার্ক ম্যাটার আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, আপনি সেটা টেরও পাবেন না। মজার না বিষয়টা!

তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করলেন?

আসলে বিজ্ঞানীরা অনেক ধরনের তত্ত্ব ও পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং।

গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং কি?

আলবার্ট আইনস্টাইন গ্র্যাভিটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এর ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাকাশে যখন কোথাও ভর থাকে, তখন তার চারদিকের স্থান-কাল(স্পেস-টাইম) বাঁকিয়ে ফেলে।

একটা উদাহরণ দেই, আমরা সবাই তো শামিয়ানা (কাপড়ের তৈরি অস্হায়ী ছাদবিশেষ) দেখেছি। ধরুন, আপনার সামনে একটা শামিয়ানা টাঙানো আছে। তো এর মধ্যে যদি আপনি একটা ছোট বল ফেলে দেন, কি হবে?

উত্তরটা সহজ তাই না। বলটা মাঝখানে পড়বে আর গর্তের মত একটা জায়গার সৃষ্টি হবে। তখন যদি শামিয়ানার আশেপাশেও কোন বস্তু রাখেন, তাহলে সেগুলোও ঐ গর্তে পড়ে যাবে।

ঠিক এমনটাই ঘটে আমাদের মহাকাশে। বস্তুগুলো যেখানে থাকে সেখানে একটা গর্তের মত সৃষ্টি হয়। যেহেতু একটা ভর ঐ জায়গা দখল করে আছে, তাহলে অবশ্যই এর মধ্য দিয়ে যখন আলো আসবে আলোটাও তীর্যকভাবে আসবে। মানে লেন্সের ক্ষেত্রে যেরকম আলো বেঁকে যায়, ঠিক সেরকম। এজন্যই একে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং বলে।

যখন এই তীর্যকভাবে আলোটা আসে, তখন ঐ বস্তুর পেছনে থাকা সবকিছুর একটা বিকৃত (ডিসটর্টেট) প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়। এই বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখেই আসলে বোঝা যায়, ভর কি পরিমাণে আছে এবং কোথায় আছে। এই পরিমাণটাই আসলে সেখানে বিদ্যমান মোট বস্তুর পরিমাণ। মানে হোক সেটা দৃশ্যমান বস্তু, কিংবা ডার্ক ম্যাটার।

এর পরের ধাপটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন। সেই মোট ভর থেকে আমরা যে বস্তুগুলো শনাক্ত করতে পারছি, তা বিয়োগ করলেই সেখানে থাকা ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।

আসলেই মহাকাশে প্রায়শই এরকম বিকৃত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। আর মজার ব্যাপার হলো, প্রায় সময়ই দেখা যায়, ঐ বিকৃত প্রতিচ্ছবি তৈরি হওয়ার জন্য যে পরিমাণ ভর দরকার, সে পরিমাণ ভর পাওয়া যায় না। তাহলে ঐ অতিরিক্ত ভর এলো কোথায় থেকে? সহজ উত্তর, ডার্ক ম্যাটার।

ডার্ক ম্যাটার নিয়ে এত ঘাটাঘাটি কেন

আচ্ছা, এই ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি, এগুলো নিয়ে কেন আমাদের এত ঘাটাঘাটি? কি লাভ? হ্যাঁ,লাভ আছে। শুধু লাভ না,বিষয়টা রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং।

ডার্ক ম্যাটার এনার্জি

আমাদের মহাবিশ্বের প্রায় ৬৮-৬৯% দখল করে আছে ডার্ক এনার্জি। যা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। কিন্তু এটা তো ষোলআনা সত্যি, যে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব আছে এবং সেটা প্রমাণিত।

যদি না-ই থাকতো, তাহলে কখনোই এই বিপুল মহাবিশ্ব গঠিত হতো না। হওয়ার আগেই তীব্র কেন্দ্রবিমুখী বলের জন্য সব কিছু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আর মহাবিশ্ব না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো কোথায়?

এই ম্যাটার এমন সব আচরণ করে যা আমাদের চির পরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে। তাহলে কি এমনটা হতে পারে, যে আমাদের চেনা সূত্রগুলো আসলে ত্রুটিপূর্ণ? নাকি অন্য আরো তত্ত্ব আছে, যা আমাদের নাকের ডগায়, অথচ আমরা ধরতে পারছি না?

এই সবকিছুর সমাধান করতে পারব যদি আমরা ডার্ক ম্যাটারের রহস্য উন্মোচন করতে পারি। হয়তো সেটা সম্ভব হবে, সুদূর ভবিষ্যতে, কে জানে হয়তো সেসময় খুবই নিকটে!

লেখক: Samira Tasnim

I am Samira Tasnim. Now I am a student.Want to learn, want to spread knowledge.Writting is my passion. Always I try to compete my work timely and with 100% honesty.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *