রুকি নদী (Ruki River) বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অন্ধকার নদী হিসেবে পরিচিত। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের এই নদীটি কঙ্গো নদীর একটি উপনদী। অন্যান্য প্রধান গ্রীষ্মমন্ডলীয় নদীর তুলনায় রুকি পৃথিবীর সবচেয়ে কালো পানির নদী হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। কঙ্গো বেসিনের কার্বন চক্রের একটি পর্যবেক্ষণে গবেষক আবিষ্কার করেন বিশ্বের অন্ধকারতম কালো পানির এই নদীটি। এটি আমাজনের বিখ্যাত রিও নিগ্রোর চেয়ে অনেক বেশি গাঢ়।
সম্প্রতি এই রুকি নদীর পানি কেন এতো ঘন কালো বর্ণ ধারণ করেছে এবং এর রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করেছে গবেষকরা। পৃথিবীর এই অদ্ভুত নদীটির পরিচিতি, অবস্থান, কেন রুকি বিশ্বের সবচেয়ে অন্ধকার নদী হতে পারে, এর গবেষণা, রাসায়নিক গঠন এবং পৃথিবীর জলবায়ুতে এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন এই লেখা থেকে।
রুকি নদী (Ruki River)
পৃথিবীর আশ্চর্যকর স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম রুকি নদীটি মধ্য কঙ্গো নদীমাতৃকার অববাহিকার কুভেট সেন্ট্রালের প্রধান একটি নদী। কঙ্গোর নদী প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এই নদীটির প্রায় সম্পূর্ণ অববাহিকা জুড়েই আদিম নিচুভূমি, বন এবং জলাভূমি রয়েছে। এই কঙ্গো নদীমাতৃকার প্রধান নদী গুলো হলো: রুকি-বুসিরা, মমবোয়ো-লুইলাকা, শুয়াপা, লোমেলা এবং সালোঙ্গা। বর্তমানে সেই রুকি-বুসিরা নদী নিয়েই নতুন রহস্যের উদ্ভাবন হয়েছে।
রুকি নদীটি মূলত কঙ্গো নদীর ইঙ্গেন্দের অববাহিকায় তৈরি হয়েছে। এটি প্রায় ১০৩ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে প্রবাহিত হয়। কঙ্গোর মোমবয়ো নদী এবং বুসিরা নদীর মিলিত হওয়ার স্থানটি থেকে শুরু হয়ে রুকি নদীটি পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এটি এমবান্দাকা শহরের উত্তরে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব দিক থেকে কঙ্গোতে প্রবেশ করেছে। রুকি এবং এর প্রধান উপনদী বুসিরা সারা বছর প্রবাহিত হতে পারে। এই নদীর গড় গভীরতা ১ মিটারের বেশি এবং বন্যার সময় এর গভীরতা ২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
কিছুকাল পূর্বে, এই অঞ্চলের এক অভিযাত্রী ‘হেনরি মর্টন স্ট্যানলি’ এই অদ্ভুত নদীটির সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি একে মহিন্দু নদী নামে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীতে, বুঙ্গাটার স্থানীয় এক ব্যক্তি একে রুকি নামকরণ করেন, যার অর্থ কালো। স্ট্যানলি প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে এই নদীর আকার এবং স্থানীয় জনগণের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অনুমান করেছিলেন যে, এই নদীটি প্রায় ১০৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত নৌযানযোগ্য হতে পারে। মূলত তিনি রুটি নদী ধরে কঙ্গো নদীর অববাহিকার নৌযানযোগ্য হওয়ার অবস্থার কথা প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীতে এটি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা হয় এবং এর অন্ধকারের রহস্য উন্মোচিত হয়।
রুকি নদীর অবস্থান
রুকি নদীটি মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো নদীর উত্তর-পশ্চিম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের একটি নদী। এটি ইঙ্গেন্দের উপরে মোমবোয়ো এবং বুসিরা নদীর মিলন কেন্দ্রে গঠিত হয়েছে। এটি মোমবোয়োর মুখ থেকে নিচের দিকে প্রসারিত, এবং ইঙ্গেন্ডে থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত।
রুকি নদীর পানির রং কালো হওয়ার কারন
সাধারণত একটি নদীর রঙ আসে নিম্ন স্তরের পলি থেকে এবং উচ্চ মাত্রায় দ্রবীভূত জৈব পদার্থ থেকে। রুকি নদীতে সেই সকল দ্রবীভূত জৈব পদার্থ বেশি থাকায় এবং নদীর নিম্ন গ্রেডিয়েন্টের কারণে পলি খুব কম থাকায় এই নদীর পানির রং কালো বর্ণ ধারণ করেছে।
রুকি নদী নিয়ে নানান তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর গবেষকরা এই নদীটি পর্যবেক্ষণের জন্য এসেছিলেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো যে, শক্তিশালী কঙ্গো নদীটির উপনদী হয়েও এই রুকি নদীর পানি অত্যন্ত কালো। আক্ষরিক অর্থে এর কালো বর্ণের পানিতে একজন মানুষের মুখের সামনে হাত রাখলেও তা দেখা যাবে না।
আরো পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ার এক জলাভূমি সবে মাত্র গোলাপি হয়েছে। কেন এই ঘটবে?
Limnography and Oceanography জার্নালে ETH Zurich -এর গবেষক ট্র্যাভিস ড্রেক এই রুকি নদী নিয়ে তার গবেষণার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছিলেন। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রুকি নদীর গ্রেডিয়েন্ট খুবই কম, তাই নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় যখন বৃষ্টিপাত হয় তখন পচনশীল উদ্ভিদের উপাদান থেকে জৈব যৌগ গুলো বের হয়ে আসে। গাছপালা থেকে যেই জৈব যৌগগুলো প্রবাহিত হয় তা রুকি নদীতে নেমে আসে।
এছাড়াও পচনহীন গাছপালা দিয়ে তৈরি বিশাল পিট বগ নদীর ধারেই রয়েছে। বর্ষাকালে যখন নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় তখন আশেপাশের বনাঞ্চলগুলোতে এর পানি প্লাবিত হয়। পানির সেই স্তর নিচে নেমে আসতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। এই দীর্ঘ সময়ে জঙ্গলের সকল জৈব পদার্থ পানির সাথে মিসে রুকি নদীতে চলে আসে।
রুকি নদী নিয়ে গবেষণা ও সংশ্লিষ্ট গবেষণা কেন্দ্র
কঙ্গো নদীর অববাহিকা নিয়ে গবেষণার সূচনা হয়েছিল প্রায় ৯০ বছর পূর্বে। ১৯৩০ সাল থেকে নদীর বিভিন্ন মৌসুমী জলের স্তর নথিভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর রাসায়নিক সংমিশ্রণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৯৫১ সালে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে কঙ্গো অববাহিকার রুকি নদী নিয়ে রোমাঞ্চকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এটি নিয়ে গবেষণায় তেমন ব্যস্ত হয়নি বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রগুলো।
২০১৯ সালে, ড্রেক এবং তার সহকর্মীরা এমবান্দাকা শহরের কাছে একটি পরিমাপ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। এটি ছিল রুকি এবং কঙ্গো নদীর একত্রিত হওয়ার স্থান থেকে স্বল্প দূরত্বের উজানে। গবেষকরা সেখানে প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর জলের স্রাব এবং টানা এক বছরের যাবত প্রতিদিন জলের স্তর পরিমাপ করেছিলেন।
গবেষক ট্র্যাভিস ড্রেক ও তার দলের গবেষণার ক্ষেত্রে এমবান্দাকার কোনো স্থায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। এমনকি, বন্যার স্তর পরিমাপ করার জন্য তাদের একটি পাওয়ার ড্রিলও ছিল না। শুধুমাত্র কয়েকটি ডিজেল জেনারেটর এবং খুব কম অবকাঠামো নিয়ে তারা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
রুকি নদীর রাসায়নিক গঠন
গবেষক ট্র্যাভিস ড্রেক সহ একটি গবেষক দল রুকি নদীর রাসায়নিক গঠন সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই নদীর পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, পানিতে দ্রবীভূত জৈব কার্বন (Dissolved Organic Carbon- DOC) -এর পরিমাণ ছিল তুলনামূলক বেশি। ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য পুনরায় তদন্তকারী গবেষণা টিম সেটি অনুসন্ধান করেন।
তাদের গবেষণা অনুযায়ী, রুকি নদীর জৈব যৌগ কঙ্গো নদীর চেয়ে ৪ গুণ বেশি এবং রিও নিগ্রো নদীর থেকে প্রায় ১.৫ গুণ বেশি। গবেষণার অতিরিক্ত অংশ হিসেবে জানা যায়, রুকি উপনদীটি কঙ্গোর অববাহিকার প্রায় ২০ ভাগের ১ ভাগ হলেও, কঙ্গো নদীর মোট দ্রবীভূত জৈব কার্বনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ রুকি নদী থেকে উৎপন্ন হয়।
মূলত রুকি একটি ধীর গতির নদী এবং কার্বন ডাই অক্সাইড সেই শান্ত পরিবেশে সহজে পানি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তাই এখানে জৈব কার্বনের পরিমাণ অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কার্বনের অধিকাংশই আসে বনের পচা গাছপালা থেকে, এগুলো কোন ‘পিট বগ’ এর অংশ নয়।
রুকি নদীর সম্ভাব্য ভয়াবহতা ও জলবায়ুতে প্রভাব
রুকি শুধুমাত্র একটি অন্ধকার পানির নদীই নয় বরং রুকি বিশ্বের অন্যতম DOC-সমৃদ্ধ নদী। নদীর অস্বাভাবিক অন্ধকারের চেয়েও এখানে আরও অনেক আশ্চর্যকর উপাদান রয়েছে। DOC সাধারণত জৈব এসিডের আকারে আসে যা নদীর পানির অম্লতা বাড়ায়। এটি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণকে বৃদ্ধি করে। এই অ্যাসিডগুলো পানিতে থাকা কার্বনেট গুলোকে দ্রবীভূত করে।
রুকি নদীর অববাহিকা নিষ্কাশন ব্যবস্থা অনেক বেশি বিস্তৃত, যা সুইজারল্যান্ডের দৈর্ঘ্যের চেয়েও ৪ গুণ বেশি। কিন্তু এই বিশাল আকৃতির নদীটি নিম্নভূমি রেইনফরেস্ট দ্বারা আচ্ছাদিত। এই নদীর ধারে রয়েছে বড় বড় পিট বগ রয়েছে। এই পিট বগ গুলো প্রচুর পরিমাণে অপরিশোধিত মৃত উদ্ভিদ উপাদান সংরক্ষণ করে রেখেছে এবং এগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন নদীতে দ্রবীভূত করে।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, গবেষক ম্যাটি বার্থেল জানিয়েছেন কঙ্গো বেসিনের পিট বগগুলো প্রায় ২৯ বিলিয়ন টন কার্বন সঞ্চয় করে রাখতে সক্ষম। তবে পিট বগগুলো প্রায় সারা বছরই পানির নিচে তলিয়ে থাকায় তা অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে না। ফলে জৈব উপাদানগুলি নির্গত হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই এবং এটি পরিবেশের জন্য সুবিধাজনক।
কিন্তু ভূমি ব্যবহারে যে কোনো পরিবর্তন, যেমন- বন উজাড় করা, শুষ্ক অবস্থার সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি পরিবেশের সেই ভারসাম্যক্ষে বিপর্যস্ত করতে পারে। অতিরিক্ত বন উজারকরনের ফলে নদী এবং জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাছাড়া নদীর গভীরতা কমতে থাকে নানা কারণে। এর ফলে পিট বগগুলো শুকিয়ে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পচে যেতে পারে। এমন অবস্থায় সৃষ্টি হলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে, যা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর ক্ষতিসাধানের জন্য যথেষ্ট।
শেষকথা
বর্তমান সময়ে রুকি নদীর অন্ধকারত্বের কথা প্রকাশিত হলেও এর পানি কালো বর্ণ ধারণ করার যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বে। প্রাচীনকাল থেকে এই নদীর পার্শ্ববর্তী গাছপালা গুলোর জৈব যৌগ পানিতে প্রবাহিত হয়েই বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। বন উজাড়করন বা মাটি খনন করে খনিজ পদার্থ উত্তোলন ইত্যাদি কাজের প্রভাবে এই রুকি নদীটি মানবজাতির বসবাসের জন্য পৃথিবীকে অনুপযোগী গড়ে তুলতে পারে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সকলকেই সচেষ্ট থাকা উচিত।