মানুষ কেন প্রেমে পড়ে

মানুষ কেন প্রেমে পড়ে? বিজ্ঞান কী বলে?

মানুষ কেন প্রেমে পড়ে? পৃথিবীটা প্রেম-ভালোবাসাময়, অন্তত প্রেমিক-প্রেমিকারাই এ কথা বিশ্বাস করে। প্রেম মানুষকে যেমন গড়ে আবার ভাঙেও। প্রেমের উন্মাদনায় সাত সমুদ্র-তেরো নদী পাড়ি দেয় প্রেমিক-প্রেমিকারা, মৃত্যুর মতো কঠিন বিষয়টিকেও মেনে নেয় তারা। একটুখানি কথা বলার জন্য, একটা নজর দেখা কিংবা সময় কাটানোর আকুতি যেন তোলপাড় সৃষ্টি করে প্রেমিক-প্রেমিকার বুকের ভিতর। যারা নতুন প্রেমে পড়ে তাদের বেলায় তো কোন কথাই নেই। তাদেরকে দেখে মনে হয় মঙ্গল গ্রহের প্রাণী, মহাকাশ থেকে এইমাত্র নামল পৃথিবী নামের গ্রহে। তবে প্রেমের জন্য কেন মানুষের এত উন্মাদনা? কেন এত আকুতি? মানুষ কেন প্রেমে পড়ে? এর উত্তর দিয়েছে বিজ্ঞান।

জীবনধারা বিষয়ক ওয়েবসাইট ফেমিনা প্রকাশ করেছে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন।

মানুষ কেন প্রেমে পড়ে?

আপনার মনে কি কখনও আসেনি মানুষ কেন প্রেমে পড়ে? আমরা সামাজিক জীব তাই মানুষ কখনও একা থাকতে পারে না। কোন না কোন ভাবে তার সঙ্গীর প্রয়োজন হয়। প্রতিটি মানুষ এর কৌতুহল থাকে তার বিপরীত লিঙ্গের প্রতি। বিপরীত লিঙ্গের সাথে দীর্ঘকাল একটা মানুষের সময় কাটানোর পর এক পর্যায়ে তা প্রেমে রূপ নেয়।

আরো পড়ুন: ভালো প্রেমিক কেন ভালো স্বামী হতে পারেনা?

প্রেম আসক্তির মতো:-

যুক্তরাষ্ট্রের নৃতত্ববিদ হেলেন ফিশার ভালোবাসায় সুখি মানুষদের নিয়ে একটি গবেষণা করেন। হেলেন ফিশারের মতে, ভালোবাসার কারণের পেছনে গবেষকরা মস্তিষ্কের ভেনট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া (ভিটিএ)-এর এ১০ নামের কোষকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। এ১০ কোষ ডোপামিন তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

ভিটিএ মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেমে অংশ নেয়। এটি মানুষের চাওয়া, প্রেরণা, ক্ষুধা, উত্তেজনা, ভালোবাসার আবেগ ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত। আসলে এটাই মস্তিষ্কের সেই অঞ্চল যেখানে নেশা জাতীয় দ্রব্য নিলে আসক্তির অনুভূতি হয়। ভালোবাসার প্রথম ধাপে এক ধরনের নেশা তৈরি হয়। হয়তো এই কারণেই রোমান্টিকতা মাদকের মতো আসক্তি তৈরি করে।

তবে কারো প্রতি বেশি আসক্ত হওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে মস্তিষ্ক ব্যক্তিটিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে নেয়। কিং কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ড. ডেনিশ ভুগরা বলেন, ‘ভালোবাসার মধ্যে অনেক বিষয় প্রভাবিত। সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের পাশাপাশি এখানে শারীরিক ও আবেগীয় আকর্ষণের প্রভাব থাকে।’

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:-

যুক্তরাষ্ট্রের রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিশার ভালোবাসাকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। ভাগগুলো হলো:-

  • ১.কাম,
  • ২.আকর্ষণ ও
  • ৩.আসক্তি।

এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় হরমোনের দ্বারা। এই তিনটি আবেগই একসঙ্গেও তৈরি হতে পারে, আবার আলাদা আলাদা ভাবেও তৈরি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাই হয়তো মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের প্রতি আসক্তি, আকর্ষণ ও কামবোধ করে থাকে।

১.কাম:-

মানুষের যৌন (সেক্স) হরমোন টেসটোসটেরন ও ইসট্রোজেনের রাজত্ব এখানেই থাকে। এটি নারী-পুরুষ দু’জনের মধ্যেই কাজ করে। গবেষকদের মতে, এই পর্যায়ের ব্যাপ্তি থাকে প্রায় দুই বছর। এর লক্ষণ হলো: কোনো ব্যক্তির প্রতি তীব্র শারীরিক চাহিদার অনুভব; এটি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার শারীরিক গঠনেরে উপর। এখানে বাহ্যিক সৌন্দর্যটাই মূল বিষয়। আপনি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা হবেন, বন্ধু হওয়ার জন্য কোন প্রয়োজনবোধ করবেন না।

২.আকর্ষণ:-

প্রেমের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায় হল আকর্ষণ। এখানে মস্তিষ্কের ডোপামিন ও নোরিপাইন নামক রাসায়নিক উচ্চ মাত্রায় যুক্ত। এটি প্রেমিক-প্রেমিকার অনেকক্ষণ একসঙ্গে সময় কাটানোর বাসনা তৈরি করে থাকে। এতে প্রেমের ‘হ্যাপি ক্যামিক্যাল’বা সুখি রাসায়নিক সেরেটোনিন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনই ক্ষুধা ও মেজাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। গবেষকদের ধারণা, এটি হল প্রেমের প্রাথমিক পর্যায়ের মোহ তৈরির কারণ। এটি মূলত রোমান্টিক বা কমেডি প্রেম। আকর্ষণের এই প্রেম-ভারোবাসা সাধারণত স্থায়ী হয় ১৮ মাস থেকে ৩ বছর পর্যন্ত।

মনোবিদ ও সম্পর্ক বিষয়ক কাউন্সেলর ভিরি শর্মা বলেন, ‘সম্পর্ক আসলে স্থায়ী হয় একজন আরেক জনের মনকে বুঝা, ধৈর্য এবং আবেগীয় মাধ্যমের উপর।’ কাম ও আকর্ষণ উভয়ই প্রেমের ক্ষেত্রে যন্ত্রনা বা বাধাদায়ক। যার সঙ্গে আপনি শারীরিক সম্পর্কে যুক্ত থাকবেন তার সঙ্গে আপনার ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
এই প্রেমের লক্ষণ হলো:- প্রেমিক-প্রেমিকা পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম, সঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গী না থাকলে নিজেকে অসম্পূর্ণ লাগে।

৩.আসক্তি:-

প্রেমের তৃতীয় পর্যায় আসক্তি। সাধারণত আকর্ষণ ও কাম দুটো পর্যায় পার হওয়ার পর আসক্তি তৈরি হয়। আর আসক্তি হল দীর্ঘমেয়াদি প্রেমের প্রাথমিক স্তর। এই আবেগ মূলত ঘটে অক্সিটোসিন ও ভ্যাসোপ্রেসিন নামের ক্যামিক্যালের কারণে। কাম, আকর্ষণ বা আসক্তি হরমোনের বিক্রিয়ার কারণে তৈরি হয়। তবে আসক্তির সম্পর্ক দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। এই প্রেমের লক্ষণ হল:- সঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গী থাকলে উষ্ণতা বোধ করা, নিজের সবকিছুই সঙ্গীর সাথে শেয়ার করা, সঙ্গীকে পাশে পেলে নিরাপদ বোধ করা, সঙ্গীর প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া এবং তার বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হতে চাওয়া।

আরো পড়ুন: বিয়ের আঙটি কেন অনামিকায় বা ৪র্থ আঙ্গুলে পড়ানো হয়?

কীভাবে হবে দীর্ঘমেয়াদি ভালোবাসা?

প্রায় সময় সঙ্গী কম সাড়া দেয়, অর্থনৈতিক বা মানসিক চাপে, যৌনতার একঘেয়েমি ইত্যাদির কারণে এই সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে। এসব সমস্যার সমাধানে পেতে বিশেষজ্ঞদের পরমর্শ হল:- পরিকল্পনা ছাড়াই দুই জনের মধ্যে দূরত্ব বাড়ান। সঙ্গীকে আপনার সম্পত্তি ভাববেন না। সে আপনার সম্পদ, যাকে অর্জন করতে হবে। নিজেদের মধ্যে বেশি বেশি সময় কাটান। যাতে একজন আরেক জনের ভালো লাগা সম্পর্কে জানে।

ভালোবাসায় কেন কষ্ট?

হরমোন বিক্রিয়ার কারণে মানুষের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ঘটে। তবে ভালোবাসারও অন্ধকার দিক আছে। বিচ্ছেদের পরে প্রত্যেক মস্তিষ্ক থেকে করটিসল নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। এটি একটি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন বটে। শারীরিক কোনো ফ্র্যাকচার বা ভাঙনের কারণে শরীরে যেমন কষ্টের অনুভূতি হয়, মনেরও ঠিক একই রকমের ব্যথার অনুভূতি হয়। ভাল ভালোবাসুন, তবে অবশ্যই বুঝে শুনে সঠিক মানুষকে।

প্রেমে পড়া মানুষ হয় নির্ভার ও নির্ভয়। দুটি মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধন, তখন প্রেম পায় পরিপূর্ণতা। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলি ও মজনু, সেলিম ও আনারকলি, শাহজাহান ও মমতাজ, মার্ক অ্যান্টোনি ও ক্লিওপেট্রা, অবকিয়াস ও ইউরিবাইস, এসব অসম প্রেমের পেছনে রয়েছে হরমোন আর রাসায়নিকের কর্ম।

আমরা ধারণা করছি ইতিমধ্যে আপনি জেনেছেন মানুষ কেন প্রেমে পড়ে? যদি পোস্ট ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করে আপনার বন্ধুদের দেখার সুযোগ করে দিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social Share Buttons and Icons powered by Ultimatelysocial