ইউনিসেফ এর একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জন শিশুসহ এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষের শরীরের রক্তে সীসার মাত্রা ৫ μg/dl বা তার উপরে রয়েছে। খুব দ্রুত এই সীসা বিষক্রিয়া সমস্যার মোকাবেলা/ প্রতিকার না করলে, পৃথিবীব্যাপী এটি ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
সীসা বিষক্রিয়া একটি শিশুর বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বাধা প্রদানের পাশাপাশি একটা শিশুকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। এটি একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের উপরে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কীভাবে সীসা বিষক্রিয়া একটি প্রজন্মের ব্যক্তিত্বকে পরিবর্তন করেছে সে সম্পর্কে সতর্কতামূলক তথ্যসমূহ জানতে পারবেন এই লেখা থেকে।
একটি প্রজন্মের ব্যক্তিত্বকে পরিবর্তন করতে সীসা বিষক্রিয়ার প্রভাব
সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশের ওপর মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। এর কারণে একটি শিশু বড় হওয়ার পর তাদের সার্বিক সক্ষমতাও প্রভাবিত হয়। সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের সক্ষমতাকে ব্যাহত করে এবং বহু সুযোগ-সুবিধা সর্বাধিক কার্যকর ব্যবহারে বাঁধা সৃষ্টি করে।
সাম্প্রতিককালে এক গবেষণায় জানা যায় যে, শৈশবকালে যাদের দেহে সীসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি ছিল, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের দেহে নানারকম জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা বেশি। এর ফলে বহু শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক গঠন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্বল্পমাত্রার এবং নিম্ন-স্তরের বিষক্রিয়াও শিশুদের আইকিউ স্কোর হ্রাস করতে সক্ষম। এটি একটি শিশুর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা এবং মস্তিষ্কে সহিংসতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রেও ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী শিশুদের রক্তে সিসার উপস্থিতি উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত সিসার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সারা জীবনব্যাপী স্নায়বিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। এমনকি মারাত্মক সিসাদূষণ অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। সীসার বিষক্রিয়া মানুষের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোতে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে কিনা তা নিয়ে গবেষণা করেছেন- টেক্সাস ইউনিভার্সিটির ডঃ টেড শোবাবা (Dr. Ted Shobaba)।
ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সেসের কার্যপ্রণালীতে, শোবাবা আমেরিকা এবং ইউরোপ জুড়ে ১.৫ মিলিয়ন মানুষের শৈশবকালে থাকা এলাকার সীসার পরিমাপ করে বর্তমানে তাদের ব্যক্তিত্ব পরীক্ষা করেছিলেন। গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ব্যক্তিত্বকে সর্বত্র আমাদের সাথে বহন করি। ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের উপর সীসার একটি নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। পৃথিবীজুড়ে এই সীসা লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করছে এবং তাদের দৈনন্দিন সিদ্ধান্ত ও আচরণকে পরিবর্তন করছে।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, শিশুদের খেলনা, সব ধরনের রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের হাঁড়িপাতিল, সবজি, চাল ও মসলা, মাটি, ছাই, পোড়ামাটি ও হলুদের গুঁড়া, পানির পাইপ ও ফিটিংস, কসমেটিকস, মাছ ধরার জাল, ড্রিংকস ক্যান, ইলেকট্রনিকস বর্জ্য, হার্বাল ওষুধ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সিসা খাদ্য, পানীয় ও ত্বকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। সিসা-এসিড ব্যাটারিগুলোর অনানুষ্ঠানিক ও নিম্নমানের পুনর্ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন বাড়ছে এর দূষণ।
এর প্রভাবে সীসা বিষক্রিয়া একটি প্রজন্মের ব্যক্তিত্বকে পরিবর্তন করছে। সম্প্রতি ইউনিসেফ থেকে এ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
মানবদেহে সীসা বিষক্রিয়া প্রসারের মাধ্যম সমূহ
মানবদেহে সীসার বিষক্রিয়া জনিত প্রভাব বিস্তার করতে প্রথমে এই ক্ষতিকর ধাতব পদার্থটি দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হয়। বর্তমানে এটি মানবদেহে প্রবেশের জন্য সবচেয়ে বড় মাধ্যম সীসা-দূষিত খাদ্য, পানি বা অন্যান্য পদার্থ খাওয়া। সীসা পুরনো পাইপের মাধ্যমে পানিতে প্রবেশ করতে পারে কিংবা অনুপযুক্ত স্টোরেজ, সীসা-গ্লাজড, সীসা-সোল্ডার পাত্রে রান্নার মাধ্যমে খাদ্যকে দূষিত করতে পারে।
তাছাড়া সীসার দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া সীসা-ভিত্তিক পেইন্ট অপসারণ, ধাতুর কাজ বা কোন শিল্প কারখানায় কাজ করলে ধুলো বা ধোঁয়ার মাধ্যমে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে সীসাভিত্তিক পণ্য, যেমন- ব্যাটারি উৎপাদন, খনি, নির্মাণ ইত্যাদি শিল্প খাতে জড়িত শ্রমিকরা সরাসরি স্পর্শ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এই বিষক্রিয়ার শিকার হচ্ছে।
যে সকল এলাকায় সীসার মাত্রা বেশি, এমন পরিবেশে বসবাস করলে নানাভাবে এর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। কিছু দেশি-বিদেশি পণ্যের মাধ্যমেও দেহে সীসার প্রসার ঘটতে পারে। যেকোনো মাধ্যমে সীসা মানবদেহে প্রবেশ করুক না কেন, এটি অত্যন্ত মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি করে।
সীসা বিষক্রিয়ার ফলে মানবদেহে যেসকল ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয়
সীসার বিষক্রিয়া প্রতিটি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে গুরুতর স্বাস্থ্যগত প্রভাব ফেলতে পারে। এটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে স্নায়ুতন্ত্র এবং দেহের অভ্যন্তরীণ অন্যান্য অঙ্গে। সীসা বিষক্রিয়ার কিছু ক্ষতিকর প্রভাব নিচে তুলে ধরা হলো:
স্নায়বিক সমস্যা: সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে। ফলে শেখার অক্ষমতা, আইকিউ কমে যাওয়া, স্বাস্থ্য বিকাশে বিলম্ব হওয়া এবং আচরণগত সমস্যা হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, এটি মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে, স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে, মেজাজ খিটখিটে হয় এবং স্নায়ুর ক্ষতিসাধন করে।
শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা: সীসার বিষক্রিয়া কিডনির ক্ষতি করতে পারে এবং আক্রান্তদের সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। এটি রক্ত স্বল্পতার কারণও হতে পারে। যার ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং অন্যান্য শারীরিক অক্ষমতা দেখা দেয়।
প্রজনন সমস্যা: সীসা বিষক্রিয়া পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের প্রজনন স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। এর ফলে গর্ভাবস্থায় শিশু ধারণক্ষমতা কমে যায় এবং অনাগত শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।
কার্ডিওভাসকুলার প্রভাব: সীসার দীর্ঘায়িত বিষক্রিয়া রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের জন্য এটি অন্যতম কারণও হতে পারে।
হজমের সমস্যা ও পাকস্থলীর সমস্যা: সীসা বিষক্রিয়ার কারণে পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ক্ষুধা হ্রাস জনিত সমস্যা হতে পারে।
অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা: এটি শরীরের বিভিন্ন কার্যকলাপ কে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির মাথাব্যথা, পেশী ও জয়েন্টে ব্যথা এবং গুরুতর ক্ষেত্রে খিঁচুনি, কোমা বা মৃত্যুও হতে পারে।
সীসা সম্পর্কে কয়েকটি ভয়াবহ তথ্য
শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সীসা অত্যন্ত বিপদজনক একটি ধাতব উপাদান। মানবদেহের জন্য সীসা সম্পর্কে কিছু ভয়াবহ অজানা তথ্যগুলো তুলে ধরা হলো:
(১) সিসা সর্বত্রই রয়েছে
একটি গবেষণা অনুযায়ী জানা যায় যে, সিসা সর্বত্রই রয়েছে এবং নানাভাবে মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। শিশুরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় সীসার সংস্পর্শে আসতে পারে। এটি খাবার পানি, পানির পাইপ, খাবারের কেন, প্রসাধনী সামগ্রী, মসলা, ঐতিহ্যগত ঔষধ এবং বিভিন্ন রং এর মধ্যেও পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে বাতাস, খাবার, পানিতে সিসা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে বিভিন্ন শিল্প খাতে সরাসরি এর ব্যবহার হচ্ছে। একজন অনাগত শিশু ও তার মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় সীসার সংস্পর্শে আসতে পারে।
(২) সীসার বিষক্রিয়া সনাক্ত করা কঠিন
একটি শিশুর শৈশবকালীন সময়ে শিশার বিষক্রিয়া সহজে সনাক্ত করা যায় না। সাধারণত একটি শিশুর দেখে নিম্ন-মাঝারি মাত্রার বিষক্রিয়ার প্রভাবে কোন শারীরিক লক্ষণ দেখা যায় না। মাঝারি থেকে উচ্চমাচার বিষক্রিয়ায় শিশুদের কিছু অনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন: অনিদ্রা, অস্বস্তি, দুর্বল মনোযোগ, মাথা ব্যথা, ক্ষুধা হ্রাস ইত্যাদি।
তবে এর লক্ষণ বুঝে ওঠার আগেই এটি উচ্চমাত্রার বিষক্রিয়ার রূপ নেয়। তখন শিশুর অনিদ্রা এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি বমি, খিঁচুনি হতে পারে, এমনকি শিশু কোমাতে পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে।
আরো পড়ুন: কেন রুকি বিশ্বের সবচেয়ে অন্ধকার নদী হতে পারে
(৩) সীসা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের বেশি প্রভাবিত করে
সীসার নেতিবাচক প্রভাবগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে অনেক বেশি প্রকাশ পায়। সাধারণত শৈশবকালে একটি শিশুর মস্তিষ্ক সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তখন প্রতি সেকেন্ডে শিশুর মস্তিষ্কে হাজার হাজার নিউরাল সংযোগ তৈরি হয়। সেসার বিষক্রিয়ার ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ম প্রক্রিয়াটিতে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া একটি শিশুর শরীর প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ৪/৫ গুণ বেশি সীসা শোষণ করে। এছাড়া শিশুরা অধিকাংশ সীসার কাছাকাছি ও ধূলিকণায় অবস্থান করে। তাই তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
(৪) সীসা বিষক্রিয়ার সামান্য পরিমাণও অনেক বেশি ক্ষতিকর
সীসা একটি অতি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন। এর নিম্ন-স্তরের বিষক্রিয়াও অনেক বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। এভাবে একটি শিশুর আইকিউ স্কোর কমে যায় এবং মনোযোগ হ্রাস পায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা স্বল্প মাত্রায় সীসার বিষক্রিয়ার শিকার হলেও আজীবন স্নায়বিক, জ্ঞানীয়, শারীরিক ক্ষতি, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদেরও কার্ডিওভাসকুলার মৃত্যু এবং কিডনি ক্ষতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। এর প্রতি বছর প্রায় ৯ লক্ষেরও বেশি অকাল মৃত্যুর শিকার হয়।
(৫) প্রতিরোধই সর্বোত্তম প্রতিকার
সাধারণত সীসার বিষক্রিয়ার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই। তাই নিম্ন মাত্রার বিষক্রিয়াও অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, আক্রান্ত শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কদের রোগ নিরাময় করা কঠিন। মানব শরীরে একবার সীসা দীর্ঘসময়ের জন্য অবস্থান করলে, তা প্রায়শই হাড় ও দাঁতে জমা হয়। ফলে এর থেকে প্রতিকার পাওয়া কঠিন। তাই বলা যায়, মানবদেহের সীসার বিষক্রিয়ার প্রতিরোধই সর্বোত্তম প্রতিকার।
শেষকথা
জীবনে বড় ধরনের শারীরিক হুমকি থেকে রক্ষা পেতে প্রতিটি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সীসা বিষক্রিয়ার উৎসগুলোর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত এবং শিল্প কারখানাগুলোতে অত্যন্ত নিরাপত্তার সাথে কার্যক্রম পরিচালনা করা আবশ্যক। বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদেরকে সীসার ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো থেকে ধরে রাখতে হবে, কারণ তারা এর জন্য বেশি সংবেদনশীল।