যুগোস্লাভিয়া পতনের কারণ কী ছিল?

যুগোস্লাভিয়া এই নামটি আমরা অনেকেই শুনে থাকবো । ৯০ এর দশকে যুগোস্লাভিয়া ছিল ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তিশালী একটি দেশ । কিন্তু এটি এই দেশটি এখন আর নেই মানে কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে । চলুন জেনে নেই সেই কঠিন বাস্তব ইতিহাস, যা থেকে আমাদের শিক্ষনীয় কিছু হয়তো পেতে পারি ।

 

যুগোস্লাভিয়ার ইতিহাস

মূলত যুগোস্লাভিয়া ছিল ৬ টি ভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন । ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়া , বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনা , মেসিডোনিয়া , ক্রোয়েশিয়া , স্লোভেনিয়া এবং মন্টেনিগ্রো মিলে গঠন করে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন । প্রথমদিকে তাদের সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সময় তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য , অস্ট্রো-হাঙেরিযান সাম্রাজ্য , গ্রিস ও বুলগেরিয়ার আক্রমণ থেকে দেশগুলোকে প্রতিহত করা । যুগোস্লাভিয়ার প্রতিটি অঙ্গ রাজ্যের নিজস্ব সরকার ছিল । ফেডারেশন এর প্রতিটি সরকার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখে কিন্তু শর্ত ছিল কোন আইন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণয়ন করা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না ।

যুগোস্লাভিয়া রাজধানী ছিল বেলগ্রেড । বেলগ্রেড বর্তমানে সার্বিয়ার রাজধানী । ইউরোপের অন্যতম প্রধান দুটি নদী দানিউব ও সাভার সঙ্গমস্থল স্ত্রী বেলগ্রেড । বেলগ্রেড ছিল সে সময় পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে প্রধান সেতুবন্ধের নগরী। আর এ কারণে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য , অস্ট্রো-হাঙেরিযান সাম্রাজ্যসহ ইউরোপের সব পরাশক্তিধর সাম্রাজ্য এর নয়নের মনি হয়ে উঠেছিল এই বেলগ্রেড । এটি ছিল যুগোস্লাভিয়া সবচেয়ে বড় শহর এবং ইউরোপের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী নগরীর মধ্যে একটি ।

যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্র ভাষা  ছিল সার্ব-ক্রোয়েশিয়ান । সার্বিয়ান ও ক্রোয়েশিয়ান দুটি ভাষা মিলে সার্ব-ক্রোয়েশিয়ান নামে পরিচিত । তাছাড়া স্লোভেনিয়ান , বসনিয়ান , মন্টিনিগ্রোন, আলবেনিয়ান , মেসিডোনিয়ান এসব ভাষার ও প্রচলন ছিল ।

সাংবিধানিকভাবে যুগোস্লাভিয়া ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র । সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও বরাবর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবমুক্ত । যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক কাঠামো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো তেমন রক্ষণশীল ছিল না । সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পরও পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রতি তারা যেমন ছিল ছিল ছিল উদার ছিল ; অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আদর্শিকভাবে তারা মিশে থাকতে পেরেছিল । যদিও মার্শাল টিটো যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত দেশ গুলোকে স্টালিনের প্রভাব থেকে অনেকখানি দূরে রেখে ছিলেন । প্রকৃতপক্ষে যুগোস্লাভিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল বাজার অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এই দুইয়ের মাঝামাঝি । যুগোস্লাভিয়ার সময় যাবতীয় সম্পদ ছিল রাষ্ট্র মালিকানাধীন । ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে কোন কিছু ছিল না । তবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি বাড়ির এবং একটি গাড়ির বরাদ্দ দেয়া হতো । পাশাপাশি স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সহ যাবতীয় মৌলিক অধিকারগুলো সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য ছিল । বিশেষ করে সেসময় সবচেয়ে বেশি লাভবান ছিল শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ । কাজের পাশাপাশি তাদের অবকাশ যাপনের জন্য সমুদ্রসৈকতে পাঠানো হতো এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের এই অনুদান দেয়া হতো ।

কমিউনিজমের ভাবাদর্শে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র তবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে সে সময় কোন ধরনের বিধি নিষেধ ছিল না । প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতেন । রাষ্ট্র ছিল সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত । সেসময় যুগোস্লাভিয়ার মানুষ ক্যাথলিক খ্রিস্টান , অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন । স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টান ; অন্যদিকে সার্বিয়া , মেসিডোনিয়া , মন্টেনিগ্রো এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল অর্থোডক্স খ্রিস্টান এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও কসাভোর বেশিরভাগ মানুষের ধর্ম ইসলাম । তখনকার সময় মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতির ছিল চোখে পড়ার মতো ।

যুগোস্লাভিয়ার পতনের কারণ

অনেকের মতে সেসময় যুগোস্লাভিয়ায় কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না । যেহেতু যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সব সম্পদ রাষ্ট্রমালিকানাধীন তাই আমলাতন্ত্র সেসময় শিখর গেড়ে বসে ছিল। বাইরের দেশগুলো থেকে বিভিন্ন খাতে যে সাহায্য আসতো তার বৃহৎ অংশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পকেটে যেত । এজন্য দেখা যায় যুগোস্লাভিয়ার পতনের পর অন্য দেশগুলোতে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তারাই যারা কমিউনিস্ট সরকারের সরকারের সবচেয়ে আস্থাভাজন ছিলেন । তারা রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানিগুলো সস্তা মূল্যে নিজেদের নামে কিনে নিতে পেরেছিলেন । যুগোস্লাভিয়ার পতনের কারণ হিসেবে মার্শাল টিটো মৃত্যু-পরবর্তী নেতৃত্বের সংকটকে ও দায়ী করা হয় । পরবর্তী যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দাবি ছিল তাদের নিজেদের অংশ থেকে কাউকে যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান করা হোক । সার্ব ও ক্রোয়েশিয়েট দের একঘেয়েমি মনোভাব এক্ষেত্রে যুগোস্লাভিয়ার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে সব সময় অভিযোগ ছিল রাজধানীর তাদের সীমানা যুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রীয় আয়ের বড় অংশ তারা কুক্ষিগত করে রাখত এবং অন্যদের তারা তাদের প্রাপ্ত অংশ দিতে গড়িমসি করে । অন্যদের উপর তার প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত । ১৯৮৯ সালে যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্লোবেদান মেলোসেভিচ। তার উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব সার্বিয়ার সঙ্গে ফেডারেশন ভুক্ত দেশগুলোর দূরত্ব বাড়ায়। ফেডারেশন ভুক্ত অন্যান্য দেশের নাগরিকদের এই ধারণা হতে থাকে যে মেলোসেভিচ যুগোস্লাভিয়া কে সার্বিয়ার উপনিবেশে পরিণত করতে চলেছেন ।

যুগোস্লাভিয়া পতনের কারণ কী ছিল? যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে কয়টি রাষ্ট্র হয়, যুগোস্লাভিয়া গণহত্যা, Bosnia bangla, বসনিয়ার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল, মার্শাল টিটো
মার্শাল টিটো

১৯৯১ সালের ২৫শে জুন প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় স্লোভেনিয়া । সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতার দাবি অস্বীকার করে । শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ । দশ দিন স্থায়ী ছিল সেই যুদ্ধ । ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে স্বাধীনতা অর্জন সহজ হয় স্লোভেনিয়ার । স্লোভেনিয়ার দেখাদেখি ক্রোয়েশিয়া ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় । মজার ব্যাপার হচ্ছে স্লোভেনিয়াকে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া দেশটির নাম ক্রোয়েশিয়া এবং ক্রোয়েশিয়াকে ও প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়া দেশটির নাম স্লোভেনিয়া । সার্বিয়া একে একে একে ক্রোয়েশিয়া , বসনিয়া অন্ড হেরজেগোভিনা এবং কসাভো কে আক্রমণ করে বসে এবং তাদের ওপর নৃশংস গণহত্যা চালায় । বসনিয়া অন্ড হেরজেগোভিনা এবং কসাভো ক অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় তাদের উপর বিভীষিকা নেমে আসে । শুরু হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ । এ যুদ্ধ যুগোস্লাভ যুদ্ধ বা তৃতীয় বলকান যুদ্ধ নামে পরিচিত । একটা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যে কত নির্মম হতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সার্বিয়ানরা । ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সার্বিয়ান বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয় কয়েক হাজার নিরীহ নাগরিক । গণভোটের মাধমে ১৯৯২ সালের যুগোস্লাভিয়া থেকে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করে মেসিডোনিয়া । ২০০৬ সালে মন্টিনিগ্রো সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয় । ২০০৮ সালে সার্বিয়ার অধিকৃত আলবেনিয়া অংশের অধিবাসীরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় । নতুন রাষ্ট্রের নাম দেয়া হয় কসাভো । সার্বিয়া এখনো কসাভোকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে এবং স্বাধীনতা দাবী কে অস্বীকার করে । এভাবে বিশ্ব মানচিত্র থেকে চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া ।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *